মহান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে যারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, তাদের কে সামাজিক বলা হয়। যেমন: মানুষ ছাড়াও ইতর প্রাণীর ক্ষেত্রে সমাজের অস্তিত্ব দেখা যায়।
আমি দীর্ঘদিন যাবৎ সামাজিক সংগ্রামের সাথে কর্মরত রয়েছি। সমাজ সংস্কার, সামাজিক পরিবর্তন ও সমাজ পূর্ণ গঠনের লক্ষ্যে আমি অপরিসীমভাবে কাজ করছি। সমাজের অসঙ্গতি গুলো বদলে দিয়ে সমাজকে পরিপূর্ণ সুস্থ করে তোলতে আমি কিছু সংগঠন তৈরি করেছি। সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রথমেই গঠন করেছি, “আমাদের সমাজ” নামক একটি পত্রিকা। তারপর গঠন করেছি “আমাদের সমাজ প্রকাশনী” নামক একটি বই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। “আমাদের সমাজ” নামক ব্লাড ব্যাংক, আমাদের সমাজ নামক “আইটি আমাদের সমাজ”। অর্থাৎ সবগুলো প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন কাজ হলেও প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে আমাদের সমাজ। আমি মনে করি সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিকভাবে সমাজের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করবে।
সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শুধু যে, নিজের রক্তের কিংবা বংশের ব্যক্তি গুলোকে নিয়ে সমাজ তৈরি হয়, তা না। সমাজ তৈরি হয়, যে কোন বংশের কিংবা যেকোনো রক্তের অথবা যেকোনো ধর্মের ব্যক্তিবর্গ গুলো একত্রিতভাবে এক জায়গায় বসবাস করলে, তা লিখিত অথবা অলিখিত কিছু নিয়ম-কানুন ঘোষণার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থা হয়।
ধরুন আমার জন্ম অন্য কোন এলাকায়, কিন্তু আমি বসবাস করি, আপনাদের সমাজের মধ্যে। তাই বলে কি আমি আপনাদের সমাজের বাইরে কেউ? সমাজ ব্যবস্থা ঠিক এই রকম সম্মতি দেয় না। কেউ যদি প্রশ্ন করে আমি আপনার সমাজের কে? তবে উত্তরে আসতে পারে যে, আমিও আপনার সমাজের একজন। কারণ আমি সামাজিক মানুষ হিসেবে যেহেতু আপনার সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারি, সে ক্ষেত্রে আমাকে নিয়ে আপনার সমাজ গঠিত হতে পারে। এখানে সমাজের বিভাজন নাও হতে পারে।
সমাজ বলতে মূলত এমন এক ব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে একাধিক চরিত্র একত্রে কিছু নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করে, একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে। মানুষের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি একত্র হয়ে লিখিত কিংবা অলিখিত নিয়ম-কানুন তৈরি করে; এরকম একত্র বসবাসের অবস্থাকে সমাজ বলে।
বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন অঞ্চলে, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাজ গঠন করে। সে সব সমাজের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশ্রুতি রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় সমাজপতিরা এমন প্রতিশ্রুতি করে থাকেন, যা নামে মাত্র সমাজের উন্নয়ন হলেও সমাজে সংঘবদ্ধ ব্যক্তিগণ এই প্রতিশ্রুতি থেকে একেবারেই নিরুপায় হয়ে ওঠে। সমাজপতিরা এমন কিছু নিয়ম-কারণ গঠন করেন, যা সমাজের অন্য সাধারণ মানুষদের জন্য কল্যাণকর নয়। এই সমস্ত নিয়ম-কারণ গুলো শুধু সমাজের প্রতিনিধিত্ব যারা করেন, তাদের কল্যাণের জন্যই করা হয়। সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত মানুষগুলোর জীবন-যাপন হয়ে ওঠে কষ্টসাধ্য।
মানুষ ছাড়াও ইতর প্রাণীর ক্ষেত্রে সমাজের অস্তিত্ব দেখা যায়, তবে সেখানে মানুষের মতো কাঠামোবদ্ধ সমাজের দৃষ্টান্ত নজরে আসে না। সমাজের দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো:ট্যাবু বা নিষিদ্ধ আচার, ও টোট্যাম। সমাজের মধ্যে যেমন সদস্যদের মধ্যে থাকে পরস্পর সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, মমত্ব ; তেমনি তৈরি হতে পারে ঘৃণা, লোভ-ক্ষোভ, হিংসা, জিজ্ঞাসা।
তাই সমাজের মধ্যে শৃংখলা ধরে রাখার স্বার্থে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অলিখিতভাবে তৈরি হয় কিছু নিয়ম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার লঙ্ঘন চরম অসম্মানজনক, সমাজের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য। তবে নিঃসন্দেহে সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার জন্য সৌহার্দ্য, সহযোগিতা একান্ত দরকার।
সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে অর্থ, সম্পদ, মেধা, বংশ, শিক্ষা, বয়স, পেশা, লিঙ্গ, ক্ষমতা ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজের বিদ্যমান জনসংখ্যাকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করা হয়। জন্মসূত্রে সকল মানুষ সমান এমন মানবতাবাদী দর্শন পৃথিবীতে চালু থাকলেও বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন কোন সমাজ পাওয়া যাবেনা যেখানে মানুষে মানুষে পার্থক্য নেই। সামাজিক স্তরবিন্যাস সর্বজনীন। সব যুগে সব কালে সব সমাজই স্তরায়িত।
সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌল প্রত্যয়। স্তরবিন্যাস এর ইংরেজি প্রতিশব্দ stratification যা মৃত্তিকা বিজ্ঞান হতে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জৈবিক ও অজৈবিক উপাদানের উপর ভিত্তি করেই সামাজিক স্তরবিন্যাস করা হয়ে থাকে।
সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্স বলেছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে সমাজের মানুষের বিভাজন। এ বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েভার বলেছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস তথা সমাজের মানুষের বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে সম্পত্তি, ক্ষমতা ও মর্যাদা। মালভিন টিউমিন এর মতে,সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যাতে একটি সামাজিক গোষ্ঠী বা সমাজ শক্তি, সম্পত্তি, সামাজিক মূল্য ও মানসিক তুষ্টির তাররম্যের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বার্ধ রীতিতে শ্রেণীবদ্ধ হয়।
সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো সমাজের মানুষকে উঁচু নিচু শ্রেণিতে স্তরায়িতকরণ। সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন। কতিপয় সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন স্তরবিহীন সমাজ কল্পনা করা যায়না। আবার কতিপয় সমাজবিজ্ঞানী দেখিয়েছেন শ্রেণি শোষণের অবসানের মাধ্যমে স্তরবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রধান দুটি তত্ত্ব হলো-
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের জন্য পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে আছেন কার্ল মার্ক্স। মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ হতে প্রতিটি সমাজ অর্থনীতির ভিত্তিতে দুটি পরস্পর শ্রেণিতে বিভক্ত।একটি উৎপাদনের উপায়ের মালিক আর অন্যটি উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা হতে বঞ্চিত। কার্ল মার্ক্স ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিতিতে মানব সমাজকে ৫ ভাগে বিভক্ত করেছেন যথা:
মার্ক্সের মতে পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতিরা অধিক মুনাফা লাভের জন্য বেশি পরিমাণে শ্রমিক খাটাতে থাকে। এ সমাজে শ্রমিকরা অধিক শ্রম দেয় কিন্তু তাদের ন্যায্য মজুরি পায়না। এক পর্যায়ে তারা উৎপাদনের উপায় থেকে এবং উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে শ্রেণি বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। দুই শ্রেণির দ্বন্দ্ব যখন চরম আকার ধারণ করে তখন শ্রমিক শ্রেণি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে পুঁজিবাদের শ্রেণি শোষণের পরাজয় ঘটায়। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সমাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ ধাপ হলো সাম্য যেখানে প্রত্যেকে সমান সুযোগ ও অধিকার নিয়ে সমাজে বসবাস করে। ফলে এই সমাজে কোন স্তরবিন্যাস থাকেনা।
ক্রিয়াবাদী সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে ডেভিস ও মুর অন্যতম।ক্রিয়াবাদীরা মনে করেন সামাজিক স্তরবিন্যাস শ্বাশ্বত ও চিরন্তন।স্তরবিহীন কোন সমাজ লক্ষ্য করা যায়না। প্রতিটি দেশে প্রতিটি সমাজে স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়।
একটি সমাজের উপাদান কি কি হতে পারে:
সমাজের প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো মানুষ। মানুষ জাতিকে কেন্দ্র করেই তার সমাজ গড়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। সমাজের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পরিবার। আর অনেকগুলি পরিবার নিয়েই সমাজ তৈরি হয়।
সমাজের সুস্ঠু পরিচালনার জন্যেই মানবজাতি নির্মাণ করেছে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানের। সমাজের মানুষের বসবাসের সুবিধার জন্য গড়ে উঠে স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দির, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ
আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো আমাদের বসবাসরত সমাজকে একটি আদর্শসমাজ হিসেবে পরিণত করা। আর একটি আদর্শসমাজ পরিণত করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের মৌলিক দায়িত্ব হওয়া উচিত সর্বপ্রথম নিজেকে একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে গঠন করা। কেননা ব্যক্তি গঠনই হলো একটি আদর্শসমাজ গঠনের মূল হাতিয়ার।
সমাজ এর গুরুত্ব:
আমরা জানি, সমাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আমাদেরকে বিশ্বের উন্নতির জন্য একত্রে কাজ করার একটি ব্যবস্থা এবং একটি প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে। সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের জীবনযাত্রা ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছি।
আমরা সম্মিলিত সামাজিক প্রচেষ্টার কারণে এগিয়ে চলেছি। তাছাড়া, সমাজে সামাজিক বিশ্বাস, নিয়ম এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ম রয়েছে যা মানুষকে কীভাবে আচরণ করা উচিত ও অনুচিত তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।
সমাজ কিছু সুনির্ধারিত নিয়ম কানুন এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে, যার ফলে সেখানে মানুষ সহজেই বসবাস করতে পারে, একে অপরের বিপদে-আপদে এগিয়ে যায়। তাই বলা যায় সমাজ হলো সুগঠিত ও নিয়মভিত্তিক।
একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বড় হয়ে কি করবে বা না করবে, তাদের আচার-আচরণ কেমন হবে? এসব কিছু নির্ধারণ করে তারা কোন সমাজে বড় হচ্ছে। তাই প্রত্যেকের উচিত তাদের বসবাসরত সমাজকে একটি আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে তোলা।
_মোহাম্মদ শেখ কামালউদ্দিন স্মরণ
লেখক ও কলামিস্ট।