পদ্মা সেতুর প্রভাবে নৌপথে লঞ্চ ব্যবসায় ধস

লেখক: Amadersomaj
প্রকাশ: ১ বছর আগে


সময় সংবাদ রিপোর্টঃ ধস নেমেছে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথের লঞ্চ ব্যবসায়। বিশেষ করে পদ্মা সেতু চালুর পর নৌপথে যাত্রীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে লাভ তো দূরের কথা, আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন লঞ্চ মালিকরা।
ইতোমধ্যে যাত্রী স্বল্পতার কারণে নৌপথের অন্তত ১০টি রুটের লঞ্চ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে ভোলা এবং ঢাকা থেকে চাঁদপুর রুটের লঞ্চে যাত্রী থাকলেও বাকিগুলো ঈদ কেন্দ্রিক চলাচল করছে। সেগুলোতেও রয়েছে যাত্রীস্বল্পতা।

লঞ্চ মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতি দিন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যেত। এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা কমে অর্ধেকের নিচে নেম এসেছে। বাঁচার তাগিদে সব লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে পারছে সে লঞ্চ চালাচ্ছে। এ দিকে শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) এক জড়িপে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর পর গত এক বছরে ঢাকার লঞ্চযাত্রী কমেছে ৩৪ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবসায় মন্দার কারণে মালিকরা এক বছরে অন্তত ২০টি লঞ্চ স্ক্র্যাপ (ভেঙে যন্ত্রাংশসহ লোহালক্কড় বিক্রি) করে ফেলেছেন। এ ছাড়া আরো অন্তত ছয়টি লঞ্চ স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। এ অবস্থায় সীমিত পরিসরে লঞ্চ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রোটেশন প্রথা চালু করেছেন মালিকরা। সে হিসাবে পাঁচ দিন পর একটি আপডাউন ট্রিপ পাচ্ছে লঞ্চগুলো। তবে এতেও শেষরক্ষা হচ্ছে না তাদের। স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং তুলনামূলক নিরাপদ ভ্রমণ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চল তথা ঢাকা-বরিশালগামী যাত্রীদের একসময় প্রথম পছন্দ ছিল নৌপথ।

ঈদ ছাড়াও সাধারণ সময় এ রুটের লঞ্চের একটি কেবিন টিকিট পেতে হিমশিম খেতে হতো যাত্রীদের। সরকারি চাকরি পাওয়ার চেয়েও ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চের কেবিন টিকিট পাওয়া কঠিন এমন প্রবাদও ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণের সড়ক পরিবহনে জোয়ার এসেছে। উল্টো হোঁচট খেয়েছে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ ব্যবসা।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রথম দিকে লঞ্চের প্রায় অর্ধেক যাত্রী কমে যায়। তখন লঞ্চ মালিকরা বলেছিলেন, উৎসুক মানুষ পদ্মা সেতু দেখতে যায়। এ কারণে লঞ্চ বাদ দিয়ে তারা সড়কপথে যাতায়াত করে। তবে পদ্মা সেতু দেখা শেষ হয়ে গেলে যাত্রীরা আবারও লঞ্চে যাতায়াত করবে বলে মন্তব্য ছিল লঞ্চ মালিকদের।

তবে দিন দিন লঞ্চের যাত্রী তলানিতে ঠেকেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর খুব কমসংখ্যক ট্রিপে লাভ করতে পেরেছেন লঞ্চ মালিকরা। এ অবস্থায়ও ঈদ-কোরবানিসহ বিশেষ বিশেষ উৎসবের আশায় তাকিয়ে ছিলেন লঞ্চ মালিকরা। বর্তমানে লোকসানের ঘানি আরো বেড়েছে। লোকসানের কারণে অনেক মালিক তাদের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছেন।
ইতোমধ্যে যাত্রীস্বল্পতার কারণে ঢাকা থেকে বরগুনা রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে মালিকরা।

লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, কোনো রোটেশন নয়। বাঁচার তাগিদে সব লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে পারছে সে লঞ্চ চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর আগে ঢাকা থেকে বরিশাল এবং বরিশাল থেকে ঢাকা রুটে ১০টি লঞ্চ চলাচল করতো। এখন রুটিন করে মাত্র দুটি লঞ্চ চলাচল করছে। তাও দুটি লঞ্চেই যাত্রী থাকে খুব কম। এ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে পটুয়াখালী রুটে একটি করে লঞ্চ চলাচল করছে। সেটিতেও যাত্রীস্বল্পতার কারণে লোকসান হচ্ছে।
তিনি বলেন, লঞ্চগুলো নিয়মিত ট্রিপ না পাওয়ায় কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যথাসময়ে বেতন না পেয়ে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন বলেও তিনি জানান।

বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক ( ঢাকা নদীবন্দর, সদরঘাট) কবির হোসেন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে ৪১টি রুটে নৌযান চলাচল করতো। কিন্তু যাত্রীস্বল্পতার কারণে নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলের ১০টি রুটে লঞ্চ চলাচল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি রুটে অঞ্চল ভিত্তিক (স্থানীয় রুটে) কিছু লঞ্চ চলাচল করছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে বর্তমানে রোটেশন করে লঞ্চ চলাচল করছে। ঢাকা-বরিশাল রুটে আগে যেখানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি লঞ্চ চলাচল করতো, সেখানে এখন মাত্র দুটি লঞ্চ চলছে। তার পরেও যাত্রীস্বল্পতার কারণে লঞ্চ মালিকরা লোকসানে আছেন। তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে লোকজন তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। এ কারণে এখন অনেকে লঞ্চে যাচ্ছেন না।
এ দিকে শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) এক জড়িপে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতি দিন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যেত। এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা ১৭ হাজার কমে ৩৩ হাজার হয়েছে। এই হিসেবে ঢাকার লঞ্চযাত্রী কমেছে ৩৪ শতাংশ।

এ ছাড়া আগে ঢাকা থেকে প্রতিদিন অন্তত ৮০টি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যেত। এই সংখ্যা ২০টি কমে এখন হয়েছে ৬০টি। অর্থাৎ এক বছরে লঞ্চ চলাচল কমেছে ২৫ শতাংশ।

তবে প্রতিবেদনে যাত্রী ও লঞ্চ চলাচল কমে যাওয়ার পেছনে সড়কপথে পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি নাব্যতা সঙ্কট ও ঢাকার যানজটকেও দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, যথাযথভাবে নদী খনন ও পলি অপসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে অনেক নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া যানজট বিড়ম্বনায় সদরঘাট টার্মিনালে যেতে বহু মানুষের অনীহার কারণেও লঞ্চের যাত্রী কমে যাচ্ছে।

এসসিআরএফ জানায়, আগে ঢাকা থেকে নৌপথে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিগামী লঞ্চের যাত্রী। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে এসব জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করে। ফলে নৌপথে যাত্রী ও লঞ্চ দুটোই কমেছে।

 



IT Amadersomaj