মাদকবিরোধী গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলেই মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে: জাফরুল্ল্যাহ কাজল

লেখক: Amadersomaj
প্রকাশ: ১২ মাস আগে


মুহম্মদ জুবায়ের: মাদক চোরাচালান দমনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা দিন দিন যেন বেড়েই চলছে। সেই সাথে বেড়েছে মাদকাসক্ত ব্যক্তি এবং অর্থ পাচারও। জানা যায়, প্রতিবছর শুধু মাদক ব্যবসার কারণে পাচার হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশের খ্যাতিমান কলামিস্ট ও সাংবাদিক ওসমান এহতেসাম এর মুখোমুখি হয়েছেন এক সাহসী মাদকযোদ্ধা জনাব মো: জাফরুল্ল্যাহ কাজল। যিনি সাম্প্রতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নানামূখী কার্যক্রম, অজর্ন, সফলতা ও ব্যর্থতার কারণসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।

পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হল। সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন সাংবাদিক জুবাইর।

ওসমান এহতেসাম: বর্তমান জেলায় মাদকের পরিস্থিতি কেমন?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: চট্টগ্রাম বিভাগে মাদক নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি খুবই সন্তোষজনক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ প্রতিটি সংস্থা এবিষয়ে কাজ করছে। গত আট মাসে ( জানুয়ারি-ফেব্রুয়ার) আমরা ১৬ হাজার ২২৬টি অভিযান পরিচালনা করে ২ হাজার ৭৯৩ জনকে আসামি করতে সক্ষম হয়েছি।

ওসমান এহতেসাম: গত ১৮ জুন দেশের শীর্ষ মাদক কারবারিদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে এক মাসের মধ্যে এই তালিকা দাখিল করতে বলা হয়েছে। আপনারা সে তালিকা দাখিল করেছেন কিনা?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: অবশ্যই, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। হাইকোর্টের দেয়া নির্ধারিত তারিখের আগেই আমরা তালিকা করে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। তাছাড়া এটি আমাদের চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের চার স্তরে তালিকা করে থাকি। তা হল- শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী, পৃষ্ঠপোষক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী।

ওসমান এহতেসাম: যেকোনো ব্যক্তিকে অপরাধী হয়ে উঠতে মাদকের ভূমিকা কতটুকু বলে মনে করেন?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে মাদকের একটি বিশাল ভূমিকা থাকে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির প্রতিদিন মাদকের টাকা জোগাড় করতে হয়। সেই টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তারা অপরাধ জগতে চলে যাচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে অপরাধের সূত্রপাত হয় পরিবারে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে পিতা-মাতার পকেটের টাকা চুরি করছে। পিতা-মাতা অসহনীয় হয়ে পড়লে পরিবার ছেড়ে বাহিরে ছিনতাই ও সন্ত্রাসী শুরু করে। এভাবেই মাদকাসক্ত কিশোররা দিন দিন অপরাধী হয়ে উঠছে। তখন সে অপরাধ করতেও ভয় পায় না। যেকেউ তাকে অপরাধের কাজ ব্যবহার করতে পারে।

ওসমান এহতেসাম: মাদক নিয়ন্ত্রণে কোন কাজটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: মাদক নিয়ন্ত্রণে সবার আগে মাদকের চাহিদা কমাতে হবে। মাদকের চাহিদা থাকলে যে কোনভাবেই হোক মাদক আসবে। কাজেই মাদকবিরোধী গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলেই মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

ওসমান এহতেসাম: যদি সাফল্যের কথা বলি, আপনার দপ্তরের সফল দিকগুলো কি?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: অন্যান্য সংস্থার মতো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সফলতাও কম নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সচেতনতা থেকে শুরু করে গ্রেফতার অভিযানেও ভূমিকা রাখছে। এতে মাদক ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করতে পারছে না। অন্যদিকে যুব সমাজ সচেতন হচ্ছে। ফলে সচেতন মহলে মাদকের চাহিদাও কমছে। এটিই আমাদের সফলতা।

ওসমান এহতেসাম: দেশে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচাররোধে আইনি কার্যক্রম জোরদার, মাদকবিরোধী গণসচেতনতা সৃষ্টি, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশে মাদকের অপব্যবহার কমিয়ে আনার চেষ্টা করলেও কোন অবস্থাতেই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এই ব্যর্থতার কারণ কি?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: ব্যর্থতার অন্যতম কারণ মিয়ানমার। আমরা সকলেই জানি, মিয়ানমার মাদক উৎপাদনকারী দেশ। কাজেই প্রতিটি সংস্থা থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করেও মাদকের চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে সাক্ষীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। মাদকের মামলায় কেউ সাক্ষী দিতে চায় না। ফলে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও আসামিদের সাজা হয় না। তাই আমার মতামত, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ সচেতন হবে না, শুধু আইন দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

ওসমান এহতেসাম: এমন কোন সীমাবদ্ধতা আছে কি, যা পেলে কাজ করতে আরও সহজ হতো।

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: অবশ্যই, প্রতিটি দপ্তরের মতো আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়। প্রথমত, আমাদের পর্যাপ্ত জনবলের অভাব রয়েছে। আর দ্বিতীয় সংকটটি হলো গাড়ি। কোন জেলায় গাড়ি আছে ড্রাইভার নেই, কোথাও ড্রাইভার আছে গাড়ি নেই। আমি মনে করি, প্রতিটি জেলায় অন্ততপক্ষে তিনটি করে গাড়ি থাকা প্রয়োজন। অনেক সময় গাড়ি সংকটে আমাদের অভিযান ব্যাহত হয়। আরেকটি বিষয়, আমাদের জেলা ভিত্তিক জনবল থাকলেও উপজেলা ভিত্তিক কোনো জনবল নেই। বর্তমানে মাদকের ভয়াবহতা অনেক বেশি; সেই হিসেবে টেকনাফের বিশেষ জোনের ন্যায় প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে যদি জনবল সেটআপ দেয়া যায় তাহলে কাজের প্রক্রিয়া আরো গতিশীল ও সহজ হবে। দক্ষ জনবল দিলেই হবে না, তার সাথে সাথে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে গাড়িও থাকতে হবে।

ওসমান এহতেসাম: প্রতিদিন নানা ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের কাজ করতে হয়। অতিক্রম করতে হয় নানামূখী চ্যালেঞ্জ। এ পেশায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনি কোন কোন চ্যালেঞ্জের সম্মূখীন হয়েছেন?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: মাদক নিয়ে কাজ করলে চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই। সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের কাজ করতে হয়। আপনারা জানেন, আমাদের কর্মকর্তারা নিরস্ত্র। অন্যদিকে মাদক ব্যবসায়ীরা নানা রকম অস্ত্র বহন করে। কাজেই আমাদের উপর হামলার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। আমাদের ঝুঁকি নিয়েই অভিযান পরিচালনা করতে হয়।

ওসমান এহতেসাম: এই চ্যালেঞ্জিং পেশায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনটি আপনাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায়?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: মাদকের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায় দেশ প্রেম। দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে বলেই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কাজ করার শক্তি পাই।

ওসমান এহতেসাম: কর্মজীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা বলুন।

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: একটি ঘটনা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে। এটি অনেক বছরের পুরানো। তখন আমি এ পেশায় নতুন। হঠাৎ কে বা কাহারা আমার বাসায় সেদিন একটি কাফনের কাপড় পাঠিয়েছিল। কিন্তু এতে আমি একটুও বিচলিত হইনি। বরং স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ হুমকিকে শক্তি হিসেবে নিয়েছি। তাই কাফনের কাপড় পাঠিয়েও আমাকে যুদ্ধ বিরত করতে পারেনি।

ওসমান এহতেসাম: আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলবেন, কোন কোন প্রক্রিয়ায় এবং কিভাবে দেশে মাদক প্রবেশ করছে?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: আপনারা জানেন, আমাদের দেশে মাদক উৎপন্ন হয়। প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে স্রোতের মত মাদক আসছে এদেশে।ভারত থেকে আসছে ফেনসিডিল আর মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও আইস। দেশের সীমান্ত ও সমুদ্র পথে প্রতিনিয়ত অভিনব সব কৌশল ব্যবহার করে অব্যাহত রাখা হচ্ছে মাদক চোরাচালান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্বত্য তিন জেলা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

ওসমান এহতেসাম: দেশের সীমান্ত দিয়ে চুরি করে মাদক আসার অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ডের ভূমিকাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: বিজিবি ও কোস্টগার্ড দুইটি বড় সংস্থা। তারা প্রতিনিয়ত মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে তাদের অর্জনও কম নয়। তারপরও মাদক যেহেতু সীমান্ত দিয়েই প্রবেশ করে তাই তাদের আরও কঠোর হওয়া উচিত বলে মনে করি।

ওসমান এহতেসাম: গত ১১ জুন ‘মাদক ব্যবসার কারণে বছরে পাচার ৫ হাজার কোটি টাকা’ শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে আমাদের দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আর এ সময়ে শুধু মাদক ব্যবসার কারণে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার ঘটনা বড়ই দুঃখজনক। এটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার বড় অন্তরায়।

ওসমান এহতেসাম: মাদক সংক্রান্ত অর্থ পাচার রোধে এই দপ্তরের কোন পরিকল্পনা আছে কিনা?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন- ২০১৮ তে মানি লন্ডারিং নামের একটি ধারা আছে। এ ধারায় যে সকল মাদক ব্যবসায়ীরা কালো টাকার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আমাদের তদন্ত চলছে। কোন অবস্থাতেই যেন তারা অর্থ পাচার করতে না পারে। ইতোমধ্যে অর্থ পাচার রোধে আমাদের কিছু অর্জনও আছে। যেমন একটা মামলায় আমরা প্রায় ১০০ কোটি টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

ওসমান এহতেসাম: আপনাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাই।

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: আমরা পুনর্বাসন বলতে চাকরি দেয়াকে বুঝাইনি। আমাদের ভাষায় পুনর্বাসন বলতে যারা মাদক গ্রহণের ফলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন তাদের কাউন্সিলিং ও চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করে পুনরায় সমাজে সম্পৃক্ত করানোকে বুঝানো হয়েছে। তারপরও আমরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সাথে সমন্বয় করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছি।

ওসমান এহতেসাম: চিকিৎসার প্রক্রিয়াটা জানতে চাই।

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: যারা মাদকাসক্ত হয়ে গেছে তারা সমাজেরই অংশ। কারো ভাই, কারো সন্তান। মাদক সেবন করে বলে তাদের অবহেলা করা উচিত নয়। তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। তাদের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে পরিচালিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এর চারটি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১০০ শয্যা ও চট্টগ্রামে ২৫ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে গেলে যেকোন মাদকসেবী ফ্রি চিকিৎসা নিতে পারবে।

ওসমান এহতেসাম: পাঠকদের উদ্দেশ্যে কি বার্তা দিবেন?

জাফরুল্ল্যাহ কাজল: পাঠকদের মাদকের বিরুদ্ধে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।

IT Amadersomaj