রাজপথে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি;সঙ্ঘাতমুখর হয়ে উঠছে রাজনীতি

লেখক: Amadersomaj
প্রকাশ: ১ বছর আগে


সময় সংবাদ রিপোর্টঃ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজপথের রাজনীতি ক্রমেই সঙ্ঘাতের দিকেই এগোচ্ছে। রাজধানীতে বিএনপি ও সমমনাদের মহাসমাবেশ ও ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থানকে কেন্দ্র করে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। একই সাথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় এবং মামলার ঘটনার মধ্য দিয়েও সরকারের কঠোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটছে। যদিও এবার সরকারি দল অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জোরালো চাপের মুখে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিকে সরকারি দল এতদিন উপেক্ষা করে আসছিল। এখন পাশাপাশি বিরোধী দলের রাজপথের কর্মসূচিকে মোকাবেলারও প্রকাশ্য কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে সরকারি দলের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় না এলে সঙ্ঘাত বৃদ্ধি পাবে। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তার সূচনা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে। এ নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

গত শনিবার বিএনপির ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবরোধের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকারি দল পাল্টা কর্মসূচি দেয়ায় রাজপথ সঙ্ঘাতমুখর হয়ে ওঠে। রাজধানীর চারটি প্রবেশ পথে পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মীদের সাথে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষে রাজপথ রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। বিএনপির দুইজন শীর্ষ নেতা গয়েশরচন্দ্র রায় ও আমান উল্লাহ আমান পুলিশের হাতে হেনস্থা ও মারধরের শিকার হন। আহত হন অনেকে। বাসে আগুনের ঘটনা এবং পুলিশের সাজোয়া যানে হামলার ঘটনাও লক্ষ করা যায়। আহত হয় বিএনপির অনেক নেতাকর্মী। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা হয়। বিএনপির ১২০০ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয় বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা। যদিও ঘটনার পরদিনই গত রোববার সরকারি দল আওয়ামী লীগ ফের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে। বিএনপি অবশ্য ফঙ্ঘাত এড়ানোর কথা জানিয়ে রোববার কর্মসূচি না দিয়ে গতকাল সোমবার রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। বিএনপির পক্ষ থেকে সঙ্ঘাত এড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলা হচ্ছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বিএনপির সমাবেশে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। সোজা কথায় না হলে ফয়সালা হবে রাজপথে। আমরা বহুদূর এগিয়ে গেছি। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। তিনি বলেন, দেশের মানুষ একসাথে জেগে উঠেছে। দাবি একটাই, সরকারের পদত্যাগ। তিনি দাবি করেন, দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন নেই।

তবে সমাবেশ থেকে বিএনপি নতুন কোনো কর্মসূচি না দিলেও এক দফা দাবি আদায়ে শিগগিরই ঢাকাকেন্দ্রিক বড় ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে দলটি। বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিএনপি সঙ্ঘাত এড়িয়ে দাবি আদায়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব্ দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি দল অনেকটা ‘পায়ে পা দিয়ে’ সঙ্ঘাত বাধাতে চাচ্ছে। সরকার আলোচনার মাধ্যমে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিলে শেষ পর্যন্ত রাজপথেই ফায়সালা হবে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ নেতারাও বলছেন, বিএনপিকে তারা কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত নন। রাজপথের নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই তারা বিএনপি ও সমমনাদের ছেড়ে দিবেন না। বিএনপিকে মোকাবেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজপথে সক্রিয় থাকবেন।

এ দিকে বিএনপির আপাতত কোনো কর্মসূচি না থাকলে আজ মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে। গতকাল রাত পর্যন্ত জামায়াতকে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। জামায়াতও কেয়ারটেকাার সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে পৃথকভাবে। অবশ্য এর আগে সরকার এক দশক পর গত ১০ জুন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করার অনুমতি পায় জামায়াত। জামায়াতের সেই শাস্তিপূর্ণ সমাবেশে বিপুল লোকসমাগম হয়েছিল। গতকাল জামায়াতের নেতারা এক সংবাদ সম্মেলনে আজকের সমাবেশ সফল করার জন্য প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন এবং সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন।

দেশের রাজনীতি এখন রাজপথে সঙ্ঘাতমুখর হলেও এবার বিদেশী তৎপরতা রাজনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর, মার্কিক ভিসা নীতিসহ নানা বিষয় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রভাব ফেলছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজপথে বিরোধী দলের সভা সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার পেছনেও এই প্রভাব কাজ করছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। বিশেষ করে শনিবার বিএনপির দুই শেষ নেতা রাজপথে হেনস্থা হওয়ার পর একজনকে ডিবি পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তার অফিসে নিয়ে আপ্যায়ন এবং অন্য নেতাকে হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফুল ও ফল পাঠানোর ছবি ও ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। তাতে নানা ধরনের মন্তব্য থেকেই বর্তমান রাজনীতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সঙ্ঘাত সংঘর্ষের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে বিগত দুইটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার দেশ বিদেশের কেউই নির্বাচনকেন্দ্রিক সঙ্ঘাত চায় না। পাশাপাশি সবাই চাচ্ছে এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ ও সুষ্ঠু হোক। বিগত দু’টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হয়নি বলে প্রায় সকল মহল থেকেই অভিযোগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিরোধী দলের দাবির প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও সরকারি দল এই দাবি নাকচ করে বলে আসছে সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচনও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবেই। উভয় পক্ষের এই অনড় অবস্থানই রাজনীতিকে ক্রমেই সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিক বিশ্লেষক ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এমন রাজনৈতিক বৈরিতা স্বাভাবিক ব্যাপার। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর বিশ্বের ৩৫ থেকে ৪০টি দেশে হয়ে থাকে। বাকি দেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এমন সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে। মিসরের ৪ হাজার বছরে মাত্র একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও গত ৬০ বছরে একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। দুনিয়াব্যাপী এমন বৈরী রাজনীতি বিরাজমান রয়েছে। আমরাও ক্রমান্বয়ে এমন সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে দেশে আবার রাজনৈতিক সঙ্ঘাত শুরু হয়েছে। এটা আমাদের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। সহিসংতা আরো সহিংসতার জন্ম দেয়। এর ফলে আমরা অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। সহিংসতা বেসামাল পর্যায়ে গেলে আমরা কনফ্লিক্ট জোনে পড়ে যেতে পারি। তাহলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর হস্তক্ষেপের সুযোগ আরো বেড়ে যাবে। এজন্য আমাদের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে আমাদেরই সমাধান করতে হবে।



IT Amadersomaj