পালিত হোক পুত্র শিশু দিবস – নাজনীন নাহার

লেখক: আমদের সমাজ ডেক্স
প্রকাশ: ১ বছর আগে

–বাবা কন্যা দিবস কী? 
—কন্যা দিবস হলো কন্যাদের জন্য স্পেশাল দিবস মা।
যেই দিনে কন্যাদেরকে তার বাবা-মা ও আত্মীয় পরিজনরা বেশি বেশি করে ভালোবাসবে। 
—তাহলে পুত্র দিবস নেই কেন বাবা? পুত্রদের কি ভালোবাসা লাগে না! 
—হা হা হা হা পাগলি মেয়ে আমার।
আসল বিষয় হলো মেয়েদের নিরাপত্তা, অধিকার, সচেতনতা, শিক্ষা। আর এসবকিছুর জন্য একটি দিনকে বিশেষ করে পালন করা হয়। এটা করা হয় কন্যাদেরকে সম্মানিত করার জন্য। 
 
—তাহলে পুত্রদের সম্মান দিতে হবে না বাবা? 
 
–পুত্ররা তো এমনিতেই সম্মান পায় মা। 
 
–বাঃ বাবা!
পুত্ররা জন্মেই সম্মান পায়, 
আর কন্যারা দিবস গুনে সম্মান পাবে!
আচ্ছা বাবা এই কন্যা দিবসটা কে বানালো তুমি জানো?
নিশ্চয়ই কোনো পুরুষ বা বোকা কোনো নারী এটা তৈরি করেছে তাই না! 
 
–তুমি এভাবে বলছ কেন মামনী! 
 
–আমাকে বলতে হবে বাবা। কেন বলতে হবে জানো!
কারণ পুত্ররা জন্ম থেকেই সম্মানিত, নিরাপদ এবং পুরুষ হয়ে জন্মায়। 
আর কন্যারা তা নয়।
বলো তো বাবা!
কন্যারা কার কাছে অসম্মানিত হয় সবচেয়ে বেশি? 
কন্যারা সবচেয়ে অনিরাপদ থাকে কার কাছে?
কে-ইবা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে কন্যাদেরকে?
কি হলো বাবা,
বলো! 
 
—না ইয়ে মানে খারাপ পুরুষদের কাছে। 
 
—না বাবা শুধু খারাপ পুরুষদের কাছে নয়। 
কন্যারা আসলে পুরুষদের কাছেই অসম্মানিত,
কন্যারা পুরুষদের কাছেই অনিরাপদ। 
কন্যারা পুরুষদের কাছেই নির্যাতিত, 
কন্যারা পুরুষদের কাছেই ধর্ষিতা।
কেন বাবা! কেন বলো?
 
–মা তুমি ছোটো মানুষ। এসব নিয়ে এত চিন্তা করো না তো। 
 
—আমি ছোটো নই বাবা। আমি নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার মানে আমি অদিতার বয়সে পৌঁছে গেছি বাবা। আমি এখন পুরুষ মানুষের খাদ্য হয়ে গেছি। আমাকেও সুযোগ পেলে আমার শিক্ষক, কারও পিতা, কারও ভাই, আমারই বন্ধুটি কিংবা আমার বা কারও স্বামী নামের হায়েনারা আমাকে সহ সকল কন্যাদের নুসরাত, সায়মা, অদিতা এবং নাম না জানা অগুনতি ধর্ষিতা কন্যাদের মতো ছিঁড়ে খাবে।
তাই চিন্তা আমাকে করতেই হবে বাবা। 
 
—মামনী তুমি শান্ত হও। সব হবে সব ঠিক হবে। 
 
— কিচ্ছু হবে না বাবা। কিচ্ছু হয় না। এই হায়েনার হিংস্র পৃথিবীতে যখন একদিকে কন্যাদিবস নিয়ে মাতামাতির উৎসব রচে। অন্যদিকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অদিতাকে তার গৃহ শিক্ষক ধর্ষণ করে হত্যা করে। তোমরা আমরা এই সংবাদে দু’ফোটা চোখের পানি ফেলে কন্যা দিবসের প্রহসনে মাতি। 
 
—এ আমাদের লজ্জা মা। আমাদের মধ্যেই অমানুষ তৈরি হচ্ছে অহরহ। 
 
—এসব থামাও বাবা। আর কোনো পুত্র আজ থেকে ‘হায়েনা পুরুষ’ না হোক। 
এখন থেকে আর কন্যা দিবস নয় বাবা ,
এখন থেকে তাই পালিত হতে হবে পুত্র দিবস। 
যেই দিবসে একজন শিশু পুত্র নিজে মানুষ হওয়ার শিক্ষা নেবে। নেবে মানুষ হওয়ার ব্রত । পৃথিবীর সকল মেয়েদেরকে সম্মান করার শিক্ষা গ্রহণ করবে প্রতিটি পুত্র শিশু এই পুত্র দিবসের দিন থেকে।। তারা নারীদেরকে মানুষ মনে করতে শিখবে। শরীরের একটা অঙ্গের ভেতরে মস্তিষ্ক ঢুকিয়ে তারা আর শুধুমাত্র পুরুষ হয়ে উঠবে না। পুত্ররা মানুষ হয়ে উঠবে। মানুষ হয়ে উঠতে হবে বাবা। 
 
—মামনী তুমি এসব নিয়ে এত বেশি ভেবো না। এর জন্য সরকার আছে।  আছে প্রশাসন।
 
—না বাবা,
প্রশাসন আছে তবে অপরাধ ঘটে যাওয়ার পরে, ধর্ষণ হয়ে যাওয়ার পরে, খুন হয়ে যাওয়ার পরে। এই প্রশাসন রাজনীতি আর ক্ষমতা ভালো বোঝে বাবা। মানুষ এবং মানুষের কল্যাণ ভালো বোঝে না।
তাই আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। পুত্র শিশুকে শিশু বয়স থেকেই শেখাতে হবে ” পুত্র তুমি মানুষ হও। পুত্র তুমি মানবিক হও।” 
তোমার মাতৃকোল, পিতারকাঁধ, খেলার মাঠ, স্কুলের ক্লাসরুম থেকে শুরু করতে হবে পুত্র শিশুর শিক্ষা, মনন, মানবতা ও নৈতিকতার উন্নয়ন। আর এজন্যই পুত্র শিশুদিবস পালন জরুরি।  
আর এই দিনে পুত্র শিশু থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সের সকল পুরুষ এবং আমাদের সকলের শিখতে হবে। শিখতে হবে যে সম্মান, অধিকার, নিরাপত্তা “পাওয়ার” শিক্ষাার চেয়ে নিরাপত্তা, সম্মান, অধিকার “দেওয়ার” শিক্ষাটা নেওয়া বেশি জরুরি। 
 
সুতরাং এখন থেকে পৃথিবী ব্যপি পালিত হবে পুত্র শিশু দিবস। শিশু বেলা থেকেই একজন পুত্র একজন নিরাপদ ভাই হবে। ধর্ষক ও হায়েনা হবে না। একজন নিরাপদ ও বিশ্বাসী স্বামী হবে। নির্যাতনকারী ও বহুগামী স্বামী হবে না। একজন মানুষ বন্ধু হবে। ধর্ষক, প্রতারক, অমানুষ বন্ধু নামের কলঙ্ক হবে না। একজন নির্ভরশীল বিশুদ্ধ বাবা হবে। অপরের কন্যা, স্ত্রী, বোনকে ধর্ষণকারী হবে না। 
 
—আমার মা আমার মামনী। তুমি একদম ঠিক বলেছ। তবে তুমি একা কিন্তু এসব করতে পারবে না। 
 
—জানি বাবা একা পারব না।  তাই তো তোমাকে বললাম। তুমি দিয়ে শুধু হোক বাবা। এক একজন বাবা মানুষ বাবা হোক। বিশুদ্ধ মননের আমার বাবাকে দিয়েই শুরু হোক মানুষ হওয়া। 
 
—আমি তো তোমার ভালো বাবা আছি। তুমিই বলো আমি তোমার ভালো বাবা নই! 
 
—অবশ্যই বাবা। তুমি আমার ভালো বাবা আছো। সকলের বাবাই তার এবং তাদের কাছে ভালো বাবা। তাহলে বিভিন্ন মা’কে মেরে রক্তাক্ত করে যে বাবারা তারা কারা?
যে বয়ষ্ক বাবাগুলো বিভিন্ন সময় কন্যা শিশু এবং প্রতিবেশীকে ধর্ষণ করে তারা কারা?
বেশ্যার বাড়িতে যে বয়ষ্ক বাবারা যায় তারা কারা বাবা?
তুমি বলতে পারো?
বলো না বাবা। আমি তোমার কাছে শিখব। আমি তোমার কাছ থেকে পুরুষ চিনব বাবা। ভালো পুরুষ, মন্দ পুরুষ, ধর্ষক পুরুষ, হায়েনা পুরুষ, প্রতারক পুরুষ। এসব আমি তোমার কাছে তোমার চোখেই চিনব বাবা। আমাকে আমার শিশু ও কিশোর বয়স থেকেই খুব ভালো ভাবে পুরুষ চিনিয়ে দাও বাবা। যাতে করে আমাকে শিক্ষকের পৌরুষ শক্তির বিকৃতিতে ধর্ষিত হয়ে মরতে না হয়। আমার ছেলে বন্ধুকে বিশ্বাস করে ঠকতে না হয়। আমার স্বামীর কাছে অপমানিত ও নির্যাতিত হতে না হয়। আমার সন্তানের পিতার কাছে প্রতারিত হতে না হয়। আমার গর্ভে ধারণ করা পুত্রের কাছে অবহেলিত হতে না হয়। 
 
—এসব কিচ্ছু হবে না তোমার সাথে। আমি আছি।  তোমার দু’টো ভাই আছে। আমরা তোমাকে রক্ষা করব মা।
 
—-বাবা! তার মানে আমাকে পুরুষদের বিকৃতি থেকে রক্ষা করবে পুরুষ! তোমরা কতক্ষণ আমাকে পাহারা দিয়ে রাখবে বাবা?
অদিতার মতো যার বাবা নেই?
কিংবা নুসরাতেরও তো ভাই ছিলো।
সায়মারও তো বাবা ছিল। 
তারা তো ওদেরকে রক্ষা করতে পারেনি বাবা। 
 
এত এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও কেন আমরা পুত্র শিশুর জন্মক্ষণ থেকেই তার মন মগজ বিকৃত হওয়ার আর্টারিগুলোতে বাইপাস করে মনুষ্যত্ব বোধ বসিয়ে দেই না! একজন মা, বাবা, প্রতিবেশি, শিক্ষক সকলে আগে মানুষ হয়ে কেন মানবতার বীজ বুনি না সঠিকভাবে আমাদের পুত্র শিশুদের মস্তিষ্কে! 
 
—বোনা তো হয় রে মা। শেখানো তো হয়। আমরা তো শিখি। তবুও কিছু মানুষ নষ্ট হয়ে যায় মা। 
 
—-একটা কথা জিজ্ঞেস করব বাবা। খুব ভেবে সত্যিটা বলবে। তোমার মনের ভেতরের সঠিক উপলব্ধিটা বলবে। সত্যিটা বলবে প্লিজ। 
 
—-আচ্ছা বলব। কি জানতে চাও! 
 
—বলো তো বাবা, পৃথিবীর সকল নারীকে তুমি কি মন থেকে সম্মান করো? সম্মানে রাখতে পারো সবসময়?
তুমি কি এই জীবনে কখনও কোনো নারীর দিকে কুনজর বা বিকৃতির কামুক নজরে তাকিয়েছ?
বাবা তুমি কি সকল নারীর জন্য নিরাপদ? 
কি হলো বাবা!
কথা বলছ না কেন!
থাক বাবা তোমাকে কিছু বলতে হবে না। তুমি আরও ভাবো বাবা। আরও গভীর ভাবে ভেবে ভেবে সত্যের কাছে পৌঁছাও। সত্যটা বোঝো বাবা। সকলের মতো হুট করে বলে না ফেলো যে, “আমি অবশ্যই পৃথিবীর সকল নারীদের জন্য নিরাপদ ” এই প্রহসনের বাক্যটা। 
 
বরং আজ থেকে তুমি এবং পৃথিবীর সকল বাবারা দু’দণ্ড ভাবুক, ভাবুক আমার ভাইটা, মায়ের পুত্ররা, স্ত্রীদের স্বামীরা, ছেলে সহপাঠী ও বন্ধুরা। ভাবুক দাদুরা, নানারা, চাচা, মামা, খালু, শিক্ষক, অফিসের পুরুষ বস, পুরুষ সহকর্মী, পিয়ন, দারোয়ান সহ সকল পুরুষ। আর ভাবতে ভাবতে সে বা তারা তাদের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা, অসুস্থতা, বিকৃতি এবং নেশাগুলো বুঝুক। বুঝুক তাদের মধ্যে কতটুকু প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধ রয়েছে। আর এভাবেই তারা সকল নারীর জন্য নিরাপদ হোক। নিরাপদ হও তুমিও আমার প্রিয় বাবা। 
 
আজ থেকে আমরা আমাদের প্রতিটি দিন থেকে একটু করে সময় নিজেদেরকে মানুষ ও মানবিক হওয়ার শিক্ষা দেই। পৃথিবীর সকল কন্যা, বোন, স্ত্রী, মা অর্থাৎ সর্বপরি সকল নারীকে প্রথমে মানুষ সম্মানে সম্মান করি। নারীর জন্য কোনো পুরুষ আর হায়েনা হয়ে না উঠুক। আর এজন্য পুত্র শিশু দিবস পালন করা হোক। নিরাপদ করা হোক কন্যা শিশুর জন্ম থেকে স্বাভাবিক মৃত্যু অবধি নারী জীবন।
 
নাজনীন নাহার 
 
নাজনীন নাহার 
সুন্দরবন কুরিয়ার 
(রাজধানী মার্কেটের পাশে) 
হাটখোলা শাখা 
ঢাকা।
IT Amadersomaj